বুধবার, ২৯ জুলাই, ২০২০

ইচ্ছাপূরণ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ইচ্ছাপূরণ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | Icchapuron - Rabindranath Tagore | রবীন্দ্রনাথ রচনা সমগ্র | Rabindranath Rachana Samagra
সুবলচন্দ্রের ছেলেটির নাম সুশীলচন্দ্র। কিন্তু সকল সময়ে নামের মতো মানুষটি হয় না। সেইজন্যই সুবলচন্দ্র কিছু দুর্বল ছিলেন এবং সুশীলচন্দ্র বড়ো শান্ত ছিলেন না।

ছেলেটি পাড়াসুদ্ধ লোককে অস্থির করিয়া বেড়াইত, সেইজন্য বাপ মাঝে মাঝে শাসন করিতে ছুটিতেন ; কিন্তু বাপের পায়ে ছিল বাত, আর ছেলেটি হরিণের মতো দৌড়িতে পারিত ; কাজেই কিল চড় চাপড় সকল সময় ঠিক জায়গায় গিয়া পড়িত না। কিন্তু সুশীলচন্দ্র দৈবাৎ যেদিন ধরা পড়িতেন, সেদিন তাহার আর রক্ষা থাকিত না।

আজ শনিবারের দিনে দুটোর সময় স্কুলের ছুটি ছিল, কিন্তু আজ স্কুলে যাইতে সুশীলের কিছুতেই মন উঠিতেছিল না। তাহার অনেকগুলা কারণ ছিল। একে তো আজ স্কুলে ভূগোলের পরীক্ষা, তাহাতে আবার ও পাড়ার বোসেদের বাড়ি আজ সন্ধ্যার সময় বাজি পোড়ানো হইবে। সকাল হইতে সেখানে ধুমধাম চলিতেছে। সুশীলের ইচ্ছা, সেইখানেই আজ দিনটা কাটাইয়া দেয়।


অনেক ভাবিয়া, শেষকালে স্কুলে যাইবার সময় বিছানায় গিয়া শুইয়া পড়িল। তাহার বাপ সুবল গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী রে, বিছানায় পড়ে আছিস যে। আজ ইস্কুলে যাবি নে ?”

সুশীল বলিল, “আমার পেট কামড়াচ্ছে, আজ আমি ইস্কুলে যেতে পারব না।”

সুবল তাহার মিথ্যা কথা সমস্ত বুঝিতে পারিলেন। মনে মনে বলিলেন, ‘রোসো, একে আজ জব্দ করতে হবে।’ এই বলিয়া কহিলেন, “পেট কামড়াচ্ছে ? তবে আর তোর কোথাও গিয়ে কাজ নেই। বোসেদের বাড়ি বাজি দেখতে হরিকে একলাই পাঠিয়ে দেব এখন। তোর জন্যে আজ লজঞ্জুস কিনে রেখেছিলুম, সেও আজ খেয়ে কাজ নেই। তুই এখানে চুপ করে পড়ে থাক্, আমি খানিকটা পাঁচন তৈরি করে নিয়ে আসি।”

এই বলিয়া তাহার ঘরে শিকল দিয়া সুবলচন্দ্র খুব তিতো পাঁচন তৈয়ার করিয়া আনিতে গেলেন। সুশীল মহা মুশকিলে পড়িয়া গেল। লজ ুস সে যেমন ভালোবাসিত পাঁচন খাইতে হইলে তাহার তেমনি সর্বনাশ বোধ হইত। ও দিকে আবার বোসেদের বাড়ি যাইবার জন্য কাল রাত হইতে তাহার মন ছট্ফট্ করিতেছে, তাহাও বুঝি বন্ধ হইল।

সুবলবাবু যখন খুব বড়ো এক বাটি পাঁচন লইয়া ঘরে ঢুকিলেন সুশীল বিছানা হইতে ধড়্ফড়্ করিয়া উঠিয়া বলিল, “আমার পেট কামড়ানো একেবারে সেরে গেছে, আমি আজ ইস্কুলে যাব।”

বাবা বলিলেন, “না না, সে কাজ নেই, তুই পাঁচন খেয়ে এইখানে চুপচাপ করে শুয়ে থাক্।” এই বলিয়া তাহাকে জোর করিয়া পাঁচন খাওয়াইয়া ঘরে তালা লাগাইয়া বাহির হইয়া গেলেন।

সুশীল বিছানায় পড়িয়া কাঁদিতে কাঁদিতে সমস্তদিন ধরিয়া কেবল মনে করিতে লাগিল যে, ‘আহা, যদি কালই আমার বাবার মতো বয়স হয়, আমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারি, আমাকে কেউ বন্ধ করে রাখতে পারে না।’

তাহার বাপ সুবলবাবু বাহিরে একলা বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন যে, ‘আমার বাপ মা আমাকে বড়ো বেশি আদর দিতেন বলেই তো আমার ভালোরকম পড়াশুনো কিছু হল না। আহা, আবার যদি সেই ছেলেবেলা ফিরে পাই তা হলে আর কিছুতেই সময় নষ্ট না করে কেবল পড়াশুনো করে নিই।’

ইচ্ছাঠাকরুন সেই সময় ঘরের বাহির দিয়া যাইতেছিলেন। তিনি বাপের ও ছেলের মনের ইচ্ছা জানিতে পারিয়া ভাবিলেন, আচ্ছা, ভালো, কিছুদিন ইহাদের ইচ্ছা পূর্ণ করিয়াই দেখা যাক।

এই ভাবিয়া বাপকে গিয়া বলিলেন, “তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হইবে। কাল হইতে তুমি তোমার ছেলের বয়স পাইবে।” ছেলেকে গিয়া বলিলেন, “কাল হইতে তুমি তোমার বাপের বয়সী হইবে।” শুনিয়া দুইজনে ভারি খুশি হইয়া উঠিলেন।

বৃদ্ধ সুবলচন্দ্র রাত্রে ভালো ঘুমাইতে পারিতেন না, ভোরের দিকটায় ঘুমাইতেন। কিন্তু আজ তাঁহার কী হইল, হঠাৎ খুব ভোরে উঠিয়া একেবারে লাফ দিয়া বিছানা হইতে নামিয়া পড়িলেন। দেখিলেন, খুব ছোটো হইয়া গেছেন ; পড়া দাঁত সবগুলি উঠিয়াছে ; মুখের গোঁফদাড়ি সমস্ত কোথায় গেছে, তাহার আর চিহ্ন নাই। রাত্রে যে ধুতি এবং জামা পরিয়া শুইয়াছিলেন, সকালবেলায় তাহা এত ঢিলা হইয়া গেছে যে, হাতের দুই আস্তিন প্রায় মাটি পর্যন্ত ঝুলিয়া পড়িয়াছে, জামার গলা বুক পর্যন্ত নাবিয়াছে, ধুতির কোঁচাটা এতই লুটাইতেছে যে, পা ফেলিয়া চলাই দায়।

আমাদের সুশীলচন্দ্র অন্যদিন ভোরে উঠিয়া চারি দিকে দৌরাত্ম্য করিয়া বেড়ান, কিন্তু আজ তাহার ঘুম আর ভাঙে না ; যখন তাহার বাপ সুবলচন্দ্রের চেঁচামেচিতে জাগিয়া উঠিল, তখন দেখিল, কাপড়চোপড়গুলো গায়ে এমনি আঁটিয়া গেছে যে, ছিঁড়িয়া ফাটিয়া কুটিকুটি হইবার জো হইয়াছে ; শরীরটা সমস্ত বাড়িয়া উঠিয়াছে ; কাঁচা-পাকা গোঁফে-দাড়িতে অর্ধেকটা মুখ দেখাই যায় না ; মাথায় একমাথা চুল ছিল, হাত দিয়া দেখে, সামনে চুল নাই – পরিষ্কার টাক তক্ তক্ করিতেছে।

আজ সকালে সুশীলচন্দ্র বিছানা ছাড়িয়া উঠিতেই চায় না। অনেকবার তুড়ি দিয়া উচ্চৈঃস্বরে হাই তুলিল ; অনেকবার এপাশ-ওপাশ করিল ; শেষকালে বাপ সুবলচন্দ্রের গোলমালে ভারি বিরক্ত হইয়া উঠিয়া পড়িল।

দুইজনের মনের ইচ্ছা পূর্ণ হইল বটে, কিন্তু ভারি মুশকিল বাধিয়া গেল। আগেই বলিয়াছি, সুশীলচন্দ্র মনে করিত যে, সে যদি তাহার বাবা সুবলচন্দ্রের মতো বড়ো এবং স্বাধীন হয়, তবে যেমন ইচ্ছা গাছে চড়িয়া, জলে ঝাঁপ দিয়া, কাঁচা আম খাইয়া, পাখির বাচ্চা পাড়িয়া, দেশময় ঘুরিয়া বেড়াইবে ; যখন ইচ্ছা ঘরে আসিয়া যাহা ইচ্ছা তাহাই খাইবে, কেহ বারণ করিবার থাকিবে না। কিন্তু আশ্চর্য এই, সেদিন সকালে উঠিয়া তাহার গাছে চড়িতে ইচ্ছাই হইল না। পানাপুকুরটা দেখিয়া তাহার মনে হইল, ইহাতে ঝাঁপ দিলেই আমার কাঁপুনি দিয়া জ্বর আসিবে। চুপচাপ করিয়া দাওয়ায় একটা মাদুর পাতিয়া বসিয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিল।

একবার মনে হইল, খেলাধুলাগুলো একেবারেই ছাড়িয়া দেওয়াটা ভালো হয় না, একবার চেষ্টা করিয়াই দেখা যাক। এই ভাবিয়া, কাছে একটা আমড়া গাছ ছিল, সেইটাতে উঠিবার জন্য অনেকরকম চেষ্টা করিল। কাল যে গাছটাতে কাঠবিড়ালির মতো তর্ তর্ করিয়া চড়িতে পারিত, আজ বুড়া শরীর লইয়া সে গাছে কিছুতেই উঠিতে পারিল না ; নিচেকার একটা কচি ডাল ধরিবামাত্র সেটা তাহার শরীরের ভারে ভাঙিয়া গেল এবং বুড়া সুশীল ধপ্ করিয়া মাটিতে পড়িয়া গেল। কাছে রাস্তা দিয়া লোক চলিতেছিল, তাহারা বুড়াকে ছেলেমানুষের মতো গাছে চড়িতে ও পড়িতে দেখিয়া হাসিয়া অস্থির হইয়া গেল। সুশীলচন্দ্র লজ্জায় মুখ নিচু করিয়া আবার সেই দাওয়ায় মাদুরে আসিয়া বসিল। চাকরকে বলিল, “ওরে, বাজার থেকে এক টাকার লজঞ্জুস কিনে আন্।”

লজঞ্জুসের প্রতি সুশীলচন্দ্রের বড়ো লোভ ছিল। স্কুলের ধারে দোকানে সে রোজ নানা রঙের লজঞ্জুস সাজানো দেখিত ; দু-চার পয়সা যাহা পাইত, তাহাতেই লজঞ্জুস কিনিয়া খাইত ; মনে করিত, যখন বাবার মতো টাকা হইবে, তখন কেবল পকেট ভরিয়া ভরিয়া লজঞ্জুস কিনিবে এবং খাইবে। আজ চাকর এক টাকায় একরাশ লজঞ্জুস কিনিয়া আনিয়া দিল ; তাহারই একটা লইয়া সে দন্তহীন মুখের মধ্যে পুরিয়া চুষিতে লাগিল ; কিন্তু বুড়ার মুখে ছেলেমানুষের লজঞ্জুস কিছুতেই ভালো লাগিল না। একবার ভাবিল, এগুলো আমার ছেলেমানুষ বাবাকে খাইতে দেওয়া যাক ; আবার তখনই মনে হইল, না কাজ নাই, এত লজঞ্জুস খাইলে উহার আবার অসুখ করিবে।

কাল পর্যন্ত যে সকল ছেলে সুশীলচন্দ্রের সঙ্গে কপাটি খেলিয়াছে, আজ তাহারা সুশীলের সন্ধানে আসিয়া বুড়ো সুশীলকে দেখিয়া দূরে ছুটিয়া গেল।

সুশীল ভাবিয়াছিল, বাপের মতো স্বাধীন হইলে তাহার সমস্ত ছেলে-বন্ধুদের সঙ্গে সমস্তদিন ধরিয়া কেবলই ডুডু ডুডু শব্দে কপাটি খেলিয়া বেড়াইবে ; কিন্তু আজ রাখাল গোপাল অক্ষয় নিবারণ হরিশ এবং নন্দকে দেখিয়া মনে মনে বিরক্ত হইয়া উঠিল ; ভাবিল, চুপচাপ করিয়া বসিয়া আছি, এখনই বুঝি ছোঁড়াগুলো গোলমাল বাধাইয়া দিবে।

আগেই বলিয়াছি, বাবা সুবলচন্দ্র প্রতিদিন দাওয়ায় মাদুর পাতিয়া বসিয়া বসিয়া ভাবিতেন, যখন ছোটো ছিলাম তখন দুষ্টামি করিয়া সময় নষ্ট করিয়াছি, ছেলেবয়স ফিরিয়া পাইলে সমস্তদিন শান্ত শিষ্ট হইয়া, ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া বসিয়া, কেবলই বই লইয়া পড়া মুখস্থ করি। এমন-কি সন্ধ্যার পরে ঠাকুরমার কাছে গল্প শোনাও বন্ধ করিয়া প্রদীপ জ্বালাইয়া রাত্রি দশটা এগারোটা পর্যন্ত পড়া তৈয়ারি করি।

কিন্তু ছেলেবয়স ফিরিয়া পাইয়া সুবলচন্দ্র কিছুতেই স্কুলমুখো হইতে চাহেন না। সুশীল বিরক্ত হইয়া আসিয়া বলিত, “বাবা, ইস্কুলে যাবে না ?” সুবল মাথা চুলকাইয়া মুখ নিচু করিয়া আস্তে আস্তে বলিতেন, “আজ আমার পেট কামড়াচ্ছে, আমি ইস্কুলে যেতে পারব না।” সুশীল রাগ করিয়া বলিত, “পারবে না বৈকি ? ইস্কুলে যাবার সময় আমার অমন ঢের পেট কামড়েছে, আমি ও-সব জানি।”

বাস্তবিক সুশীল এতরকম উপায়ে স্কুল পলাইত এবং সে এত অল্পদিনের কথা যে, তাহাকে ফাঁকি দেওয়া তাহার বাপের কর্ম নহে। সুশীল জোর করিয়া ক্ষুদ্র বাপটিকে স্কুলে পাঠাইতে আরম্ভ করিল। স্কুলের ছুটির পরে সুবল বাড়ি আসিয়া খুব একচোট ছুটাছুটি করিয়া খেলিয়া বেড়াইবার জন্য অস্থির হইয়া পড়িতেন ; কিন্তু ঠিক সেই সময়টিতে বৃদ্ধ সুশীলচন্দ্র চোখে চশমা দিয়া একখানা কৃত্তিবাসের রামায়ণ লইয়া সুর করিয়া করিয়া পড়িত, সুবলের ছুটাছুটি-গোলমালে তাহার পড়ার ব্যাঘাত হইত। তাই সে জোর করিয়া সুবলকে ধরিয়া আনিয়া সম্মুখে বসাইয়া হাতে একখানা স্লেট দিয়া আঁক কষিতে দিত। আঁকগুলো এমনি বড়ো বড়ো বাছিয়া দিত যে, তাহার একটা কষিতেই তাহার বাপের এক ঘণ্টা চলিয়া যাইত। সন্ধ্যাবেলায় বুড়া সুশীলের ঘরে অনেক বুড়ায় মিলিয়া দাবা খেলিত। সে সময়টায় সুবলকে ঠাণ্ডা রাখিবার জন্য সুশীল একজন মাস্টার রাখিয়া দিল ; মাস্টার রাত্রি দশটা পর্যন্ত তাহাকে পড়াইত।

খাওয়ার বিষয়ে সুশীলের বড়ো কড়াক্কড় ছিল। কারণ তাহার বাপ সুবল যখন বৃদ্ধ ছিলেন তখন তাঁহার খাওয়া ভালো হজম হইত না, একটু বেশি খাইলে অম্বল হইত – সুশীলের সে কথাটা বেশ মনে আছে ; সেইজন্য সে তাহার বাপকে কিছুতেই অধিক খাইতে দিত না। কিন্তু হঠাৎ অল্প বয়স হইয়া আজকাল তাঁহার এমনি ক্ষুধা হইয়াছে যে, নুড়ি হজম করিয়া ফেলিতে পারিতেন। সুশীল তাঁহাকে যতই অল্প খাইতে দিত, পেটের জ্বালায় তিনি ততই অস্থির হইয়া বেড়াইতেন। শেষকালে রোগা হইয়া শুকাইয়া তাঁহার সর্বাঙ্গের হাড় বাহির হইয়া পড়িল। সুশীল ভাবিল, শক্ত ব্যামো হইয়াছে, তাই কেবলই ঔষধ গিলাইতে লাগিল।

বুড়া সুশীলেরও বড়ো গোল বাধিল। সে তাহার পূর্বকালের অভ্যাসমত যাহা করে তাহাই তাহার সহ্য হয় না। পূর্বে সে পাড়ায় কোথাও যাত্রাগানের খবর পাইলেই, বাড়ি হইতে পালাইয়া, হিমে হোক, বৃষ্টিতে হোক, সেখানে গিয়া হাজির হইত। আজিকার বুড়া সুশীল সেই কাজ করিতে গিয়া, সর্দি হইয়া, কাশি হইয়া, গায়ে মাথায় ব্যথা হইয়া, তিন হপ্তা শয্যাগত হইয়া পড়িয়া রহিল। চিরকাল সে পুকুরে স্নান করিয়া আসিয়াছে, আজও তাহাই করিতে গিয়া হাতের গাঁট, পায়ের গাঁট ফুলিয়া বিষম বাত উপস্থিত হইল ; তাহার চিকিৎসা করিতে ছয় মাস গেল। তাহার পর হইতেই দুই দিন অন্তর সে গরম জলে স্নান করিত এবং সুবলকেও কিছুতেই পুকুরে স্নান করিতে দিত না। পূর্বেকার অভ্যাসমত, ভুলিয়া তক্তপোষ হইতে সে লাফ দিয়া নামিতে যায়, আর হাড়গুলা টন্টন্ ঝন্ঝন্ করিয়া উঠে। মুখের মধ্যে আস্ত পান পুরিয়াই হঠাৎ দেখে, দাঁত নাই, পান চিবানো অসাধ্য। ভুলিয়া চিরুনি ব্রুশ লইয়া মাথা আঁচড়াইতে গিয়া দেখে, প্রায় সকল মাথাতেই টাক। এক-একদিন হঠাৎ ভুলিয়া যাইত যে, সে তাহার বাপের বয়সী বুড়া হইয়াছে এবং ভুলিয়া পূর্বের অভ্যাসমত দুষ্টামি করিয়া পাড়ার বুড়ি আন্দিপিসির জলের কলসে হঠাৎ ঠন্ করিয়া ঢিলা ছুঁড়িয়া মারিত – বুড়ামানুষের এই ছেলেমানুষি দুষ্টামি দেখিয়া লোকেরা তাহাকে র্মা র্মা করিয়া তাড়াইয়া যাইত, সে’ও লজ্জায় মুখ রাখিবার জায়গা পাইত না।

সুবলচন্দ্রও এক-একদিন দৈবাৎ ভুলিয়া যাইত যে, সে আজকাল ছেলেমানুষ হইয়াছে। আপনাকে পূর্বের মতো বুড়া মনে করিয়া, যেখানে বুড়ামানুষেরা তাসপাশা খেলিতেছে সেইখানে গিয়া সে বসিত এবং বুড়ার মতো কথা বলিত ; শুনিয়া সকলেই তাহাকে “যা যা, খেলা র্ক গে যা, জ্যাঠামি করতে হবে না” বলিয়া কান ধরিয়া বিদায় করিয়া দিত। হঠাৎ ভুলিয়া মাস্টারকে গিয়া বলিত, “দাও তো, তামাকটা দাও তো, খেয়ে নিই।” শুনিয়া মাস্টার তাহাকে বেঞ্চের উপর একপায়ে দাঁড় করাইয়া দিত। নাপিতকে গিয়া বলিত, “ওরে বেজা, কদিন আমাকে কামাতে আসিস নি কেন।” নাপিত ভাবিত, ছেলেটি খুব ঠাট্টা করিতে শিখিয়াছে। সে উত্তর দিত, “আর বছর দশেক বাদে আসব এখন।” আবার এক-একদিন তাহার পূর্বের অভ্যাসমত তাহার ছেলে সুশীলকে গিয়া মারিত। সুশীল ভারি রাগ করিয়া বলিত, “পড়াশুনো করে তোমার এই বুদ্ধি হচ্ছে ? একরত্তি ছেলে হয়ে বুড়োমানুষের গায়ে হাত তোল?” অমনি চারিদিক হইতে লোকজন ছুটিয়া আসিয়া, কেহ কিল কেহ চড় কেহ গালি দিতে আরম্ভ করে।

তখন সুবল একান্তমনে প্রার্থনা করিতে লাগিল যে, “আহা, যদি আমি আমার ছেলে সুশীলের মতো বুড়ো হই এবং স্বাধীন হই, তাহা হইলে বাঁচিয়া যাই।”

সুশীলও প্রতিদিন জোড়হাত করিয়া বলে, “হে দেবতা, বাপের মতো আমাকে ছোটো করিয়া দাও, মনের সুখে খেলা করিয়া বেড়াই। বাবা যেরকম দুষ্টামি আরম্ভ করিয়াছেন, উঁহাকে আর আমি সামলাইতে পারি না, সর্বদা ভাবিয়া অস্থির হইলাম।”

তখন ইচ্ছাঠাকরুন আসিয়া বলিলেন, “কেমন, তোমাদের শখ মিটিয়াছে ?”

তাঁহারা দুইজনেই গড় হইয়া প্রণাম করিয়া কহিলেন, “দোহাই ঠাকরুন, মিটিয়াছে। এখন আমরা যে যাহা ছিলাম আমাদিগকে তাহাই করিয়া দাও।”

ইচ্ছাঠাকরুন বলিলেন, “আচ্ছা, কাল সকালে উঠিয়া তাহাই হইবে।”

পরদিন সকালে সুবল পূর্বের মতো বুড়া হইয়া এবং সুশীল ছেলে হইয়া জাগিয়া উঠিলেন। দুইজনেরই মনে হইল যে, স্বপ¦ হইতে জাগিয়াছি। সুবল গলা ভার করিয়া বলিলেন, “সুশীল, ব্যাকরণ মুখস্থ করবে না?”

সুশীল মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে বলিল, “বাবা, আমার বই হারিয়ে গেছে।”

আশ্বিন ১৩০২

প্রায়শ্চিত্ত - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

প্রায়শ্চিত্ত - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | icchapuron -rabindranath tagore || রবীন্দ্রনাথ রচনা সমগ্র | Rabindranath Rachana Samagra
মণীন্দ্র ছেলেটির বয়স হবে চোদ্দ। তার বুদ্ধি খুব তীক্ষ্ণ কিন্তু পড়াশুনায় বিশেষ মনোযোগ নেই। তবু সে স্বভাবতই মেধাবী বলে বৎসরে বৎসরে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু অধ্যাপকেরা তার কাছে যতটা প্রত্যাশা করেন সে-অনুরূপ ফল হয় না। মণীন্দ্রের পিতা দিব্যেন্দু ছিলেন এই বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ। কর্তব্যে ছেলের শৈথিল্য দেখে তাঁর মন উদ্‌বিগ্ন ছিল।

অক্ষয় মণীন্দ্রের সঙ্গে এক ক্লাসে পড়ে। সে বড়ো দরিদ্র। ছাত্রবৃত্তির ' পরেই তার নির্ভর। মা বিধবা। বহু কষ্টে অক্ষয়কে মানুষ করেছেন। তার পিতা প্রিয়নাথ যখন জীবিত ছিলেন তখন যথেষ্ট উপার্জন করতেন। লোকের কাছে তাঁর সম্মানও ছিল খুব বেশি। কিন্তু ব্যয় করতেও তিনি মুক্ত হস্ত ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরে দেখা গেল যত তাঁর ঋণ, সম্পত্তি তার অর্ধেকও নয়। অক্ষয়ের মা সাবিত্রী তাঁর যত কিছু অলংকার, গাড়ি ঘোড়া বাড়ি গৃহসজ্জা প্রভৃতি সমস্ত বিক্রয় করে ক্রমে ক্রমে স্বামীর ঋণ শোধ করেছেন। 

সাবিত্রী অনেকপ্রকার শিল্প জানতেন। কাপড়ের উপর রেশম ও জরির কারুকার্যে তাঁর নৈপুণ্য ছিল। দরজিরা তাঁর কাছে কাপড় রেখে যেত, তিনি ফুল কেটে পাড় বসিয়ে তার মূল্য পেতেন। তা ছাড়া তাঁর মোজা-বোনা কল ছিল, তিনি পশমের মোজা গেঞ্জি প্রস্তুত করে দোকানে বিক্রয়ের জন্যে পাঠাতেন। এই নিয়ে তাঁকে নিরন্তর পরিশ্রম করতে হত। এক-একদিন রাত্রি জেগে কাজ করতেন, নিদ্রার অবকাশ পেতেন না।

সাবিত্রীর স্বামীর এক বন্ধু ছিলেন, তার নাম সঞ্জয় মৈত্র। একসময়ে ব্যবসায়ে যখন তাঁর সর্বনাশ হবার উপক্রম হয়েছিল তখন প্রিয়নাথ নিজের দায়িত্বে অনেক টাকার ঋণ সংগ্রহ করে তাঁকে রক্ষা করেন। সঞ্জয় সেই উপকারের কৃতজ্ঞতা কখনো বিস্মৃত হন নি। প্রিয়নাথের মৃত্যুর পরে তিনি বারংবার সাবিত্রীকে অর্থসাহায্যের প্রস্তাব করেছিলেন। সাবিত্রী কিছুতেই ভিক্ষা নিতে স্বীকার করেন নি। তা ছাড়া তাঁর প্রতিজ্ঞা অর্ধাশনে থাকবেন তবু কখনো ঋণ করবেন না।

সঞ্জয়ের পুত্রের উপনয়নে একদিন তাঁর বাড়িতে সাবিত্রীর নিমন্ত্রণ ছিল। তাঁর বেশভূষা নিতান্ত সামান্য ছিল ; এক থার্ড ক্লাসের গাড়ি ভাড়া করে অক্ষয়কে নিয়ে যখন তিনি এলেন দ্বারের লোকেরা কেউ তাঁদের লক্ষ করলে না।

আজ সাবিত্রীর সকাল-সকাল বাড়ি ফেরা চাই। দরজিকে কথা দিয়েছে বিকেল তিনটের মধ্যে একটা জামার কাজ শেষ করে তাকে ফিরিয়ে দেবেন।

অন্তঃপুরে সঞ্জয়ের স্ত্রী নৃত্যকালীকে গিয়ে বললেন, “ আজ আমাদের দুজনকে সকাল-সকাল খাইয়ে বিদায় করে দাও। ”

নৃত্যকালীর ধনের অহংকার বড়ো তীব্র, তিনি সাবিত্রীর অনুরোধ গ্রাহ্যই করলেন না। ধনীঘরের কুটুম্বদের আহারের ব্যবস্থা করতে তখন তিনি ব্যস্ত ছিলেন। সাবিত্রীকে তাদের সঙ্গে একত্রে বসবার তিনি উপযুক্ত মনে করেন নি।

সাবিত্রী বাড়ির উজ্জ্বলা দাসীকে অনুনয় করে বললেন, “ কাউকে আমার জন্যে একখানা থার্ডক্লাস গাড়ি ডেকে দিতে বলে দাও, এখনি বাড়ি যাওয়া আমার বড়ো প্রয়োজন। ”

উজ্জ্বলা বললে, “ আচ্ছা, দেখছি। ” ব'লে চলে গেল। কিছুই করলে না।

অক্ষয়ের বয়স তখন খুব অল্প ছিল। সে বললে, “ মা, আমি গাড়ি ডেকে আনছি। ”

সাবিত্রী তাকে নিষেধ করে মুখের উপর ঘোমটা টেনে পথে বেরিয়ে গেলেন। ঘরে কিছু মুড়ি ছিল তাই গুড় দিয়ে মেখে অক্ষয়কে খাওয়ালেন। নিজে কিছুই খেলেন না। অক্ষয় সেইদিন প্রথম তার মায়ের চোখে জল দেখেছিল। সে কথা কোনোদিন সে ভুলতে পারে নি। সেদিন থেকে তার মনে এই প্রতিজ্ঞা ছিল, যে, বড়ো হয়ে সে তার মায়ের দুঃখ এবং অসম্মান দূর করবে। দিন রাত্রি একমনে সে পড়া করে, আর বৎসরে-বৎসরে পরীক্ষায় পুরস্কার পায়।

ক্লাসে অক্ষয় ছিল সর্বপ্রথম। মণীন্দ্রের বুদ্ধি তার চেয়ে বেশি ছিল কিন্তু পরীক্ষায় কোনোদিন তাকে অতিক্রম করতে পারে নি।

এ বৎসর পরীক্ষার সময় উপস্থিত হল। মণীন্দ্র অন্যসকল বিষয়েই ভালো উত্তর দিয়েছিল, কেবল অঙ্কের প্রশ্ন তার কঠিন ঠেকল।

অক্ষয় তার সঙ্গে এক জায়াগাতেই পরীক্ষা দিতে বসেছে। একটার সময় জলখাবারের আধঘণ্টা ছুটি ছিল। অক্ষয় দ্রুত পরীক্ষার উত্তর লেখা শেষ করে একটার কিছু আগেই বেরিয়ে গেল। ডেস্কের উপর ছিল তার কাগজগুলি। মণীন্দ্র তার থেকে দুখানা কাগজ চুরি করে নিয়ে চলে গেল, কেউ জানতে পারল না।

এবার অক্ষয়ের পরীক্ষার ফল ভালো হল না। সে বৃত্তি পাবে নিশ্চিত আশা করে ছিল কিন্তু যখন পেল না তখন সকলেই বিস্মিত হল। এবার মণীন্দ্র পেলে পুরস্কার। তার পিতা দিব্যেন্দু সকলের চেয়ে আশ্চর্য হলেন। কেন যে এমন হল তার কারণ বুঝতে পারলেন না।

হঠাৎ একদিন বুঝতে পারলেন। মণীন্দ্রের পড়বার ঘরে তার দেরাজের মধ্যে অক্ষয়ের হাতের লেখা দুখানা পরীক্ষার পত্র দিব্যেন্দুর হাতে পড়ল। মণীন্দ্র তার দুষ্কর্মের কথা স্বীকার করলে।

বিদ্যালয়ে প্রাইজ দেবার দিন উপস্থিত হল। প্রথম প্রাইজের জন্যে মণীন্দ্রের ডাক পড়ল। সে প্রাইজ হাতে নিয়ে বললে, “ এ আমার প্রাপ্য নয় — এ প্রাইজের [অধিকার] অক্ষয়ের। আমি অপরাধ করেছি। ”

বাড়ি এসে দিব্যেন্দু মণীন্দ্রকে বললেন — “ যে অপরাধ করেছ তার দণ্ড তোমার শোধ হয় নি। মণীন্দ্রের [অক্ষয়ের ] ছাত্রবৃত্তি মাসিক পনেরো টাকা নিজে থেকে তোমার দেওয়া চাই। ”

মণীন্দ্র ভেবে পেল না কী উপায়ে সে দিতে পারে। দিব্যেন্দু বললেন, “ এক বৎসর তোমাকে পায়ে হেঁটে বিদ্যালয় যেতে হবে। গাড়িঘোড়ার যে খরচ প্রতি মাসে লাগে তারি থেকে অক্ষয়ের বৃত্তির টাকা শোধ হতে পারবে। ”

মঙ্গলবার, ২১ জুলাই, ২০২০

য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র

য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর || Urop Probasir Potro by Rabindranath Tagore || রবীন্দ্রনাথ রচনা সমগ্র || Rabindranath Rachana Samagra



য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র -দশম

যুরোপ প্রবাসীর পত্র - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর || Urop Probasir Potro by Rabindranath Tagore || রবীন্দ্র রচনাবলী || Rabindra Rachanabali
ক্রিস্‌মাস ফুরোল, আবার দেখতে দেখতে আর-একটা উৎসব এসে পড়ল। আজ নূতন বর্ষের প্রথম দিন। কিন্তু তার জন্যে কিছুই গোলমাল দেখতে পাচ্ছি নে। নূতন বৎসর যে এখানে এমন নিঃশব্দ পদসঞ্চারে আসবে তা জানতেম না। শুনেছি ফ্রান্সে লোকে নতুন বৎসরকে খুব সমাদরের সঙ্গে আবাহন করে। কাল পুরাতন বৎসরের শেষ রাত্রে আমাদের প্রতিবেশীরা বাড়ির জানলা খুলে রেখেছিল। পাছে পুরোনো বৎসর ঘরের মধ্যে আটকা পড়ে থাকে, পাছে নতুন বৎসর এসে জানলার কাছে বৃথা ঘুরে ঘুরে বেড়ায়।

টর্কি থেকে বহুদিন হল আমরা আবার লণ্ডনে এসেছি। এখন আমি ক—র পরিবারের মধ্যে বাস করি। তিনি, তাঁর স্ত্রী, তাঁদের চার মেয়ে, দুই ছেলে, তিন দাসী, আমি ও টেবি বলে এক কুকুর নিয়ে এই বাড়ির জনসংখ্যা। মিস্টার ক—একজন ডাক্তার। তাঁর মাথার চুল ও দাড়ি প্রায় সমস্ত পাকা। বেশ বলিষ্ঠ ও সুশ্রী দেখতে। অমায়িক স্বভাব, অমায়িক মুখশ্রী। মিসেস ক—আমাকে আন্তরিক যত্ন করেন। শীতের সময় আমি বিশেষ গরম কাপড় না পারলে তাঁর কাছে ভর্ৎসনা খাই। খাবার সময় যদি তাঁর মনে হয়, আমি কম করে খেয়েছি, তা হলে যতক্ষণ না তাঁর মনের মতো খাই, ততক্ষণ পীড়াপীড়ি করেন। বিলেতে লোকে কাশিকে ভয় করে; যদি দৈবাৎ আমি দিনের মধ্যে দু-বার কেশেছি তা হলেই তিনি জোর করে আমার স্নান বন্ধ করান, আমাকে দশ রকম ওষুধ গেলান, শুতে যাবার আগে আমার পায়ে খানিকটা গরম জল ঢালবার বন্দোবস্ত করেন, তবে ছাড়েন। বাড়ির মধ্যে সকলের আগে বড়ো মিস ক—ওঠেন। তিনি নিচে এসে ব্রেকফাস্ট তৈরি হয়েছে কি না তদারক করেন; অগ্নি-কুণ্ডে দু-চার হাতা কয়লা দিয়ে ঘরটি বেশ উজ্জ্বল করে রাখেন। খানিক বাদ সিঁড়িতে একটা দুদ্দাড় পায়ের শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। বুড়ো ক—শীতে হি হি করতে করতে খাবার ঘরে এসে উপস্থিত। তাড়াতাড়ি আগুনে হাত-পা পিঠ-বুক তাতিয়ে খবরের কাগজ হাতে খাবার টেবিলে এসে বসেন। তাঁর বড়ো মেয়েকে চুম্বন করেন, আমার সঙ্গে সুপ্রভাত অভিবাদন হয়। লোকটা প্রফুল্ল। আমার সঙ্গে খানিকটা হাসিতামাশা হয়, খবরের কাগজ থেকে এটা-ওটা পড়ে শোনান। তাঁর এক পেয়ালা কফি শেষ হয়ে গেছে, এমন সময়ে তাঁর আর দুটি মেয়ে এসে তাঁকে চুম্বন করলেন। তাঁদের সঙ্গে তাঁর বন্দোবস্ত ছিল যে, তাঁরা যেদিন মিস্টার ক—র আগে উঠবেন, সেদিন মিস্টার ক—তাঁদের পাঁচ সিকে পুরস্কার দিবেন, আর যেদিন মিস্টার ক—তাঁদের আগে উঠবেন, সেদিন তাঁদের চার আনা দণ্ড দিতে হবে। যদিও এত অল্প দিতে হয়, তবু তাদের কাছে প্রায় দু-তিন পাউণ্ড পাওনা হয়েছে। রোজ সকালে পাওনাদার পাওনার দাবি করেন। কিন্তু দেনদাররা হেসেই উড়িয়ে দেন। ক—বলেন, “এ ভারি অন্যায়।” আমাকে মাঝে মাঝে মধ্যস্থ মেনে বলেন, “আচ্ছা মিস্টার টি—তুমিই বলো, এ-রকম ডেট অফ অনর ফাঁকি দেওয়া কি ভদ্রতা?” যা হোক পরিশোধের অভাবে পাওনা বেড়েই চলেছে। তার পরে মিসেস ক—এলেন। আমাদের ব্রেকফাস্ট প্রায় সাড়ে ন-টার মধ্যে শেষ হয়। বাড়ির বড়ো ছেলে আগেই খাওয়া সেরে কাজে গিয়েছেন, আর মিস্টার ক—র ছোটো ছেলেটি ও ছোটো মেয়েটি অনেকক্ষণ হল খাওয়া শেষ করেছে। একজনের কথা বলতে ভুলে গিয়েছি। টেবি কুকুরটি অনেকক্ষণ হল এসে আগুনের কাছে বসে আছে। ছোট্টো কুকুরটি। ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া রোঁয়া। রোঁয়াতে চোখমুখ ঢাকা। বুড়ো হয়েছে, আর তার একটা চোখ কানা হয়ে গেছে। আদর পেয়ে পেয়ে এই ব্যক্তির অভ্যাস হয়েছে নবাবি চাল। ড্রয়িংরূম ছাড়া অন্য কোনো ঘরে তার মন বসে না। ঘরের সকলের চেয়ে আলো কেদারাটিতে অম্লানবদনে লাফিয়ে উঠে বসে, এক পাশে যদি আর কেউ এসে বসল, অমনি সে সদর্পে পাশের কৌচটির উপরে গিয়ে বসে পড়ে। সকালবেলায় ব্রেকফাস্টের সময় তার তিনটি বিস্কুট বরাদ্দ। সে বিস্কুটগুলি নিয়ে খাবার ঘরে বসে থাকে, যতক্ষণ না আমি গিয়ে সেই বিস্কুটগুলি নিয়ে তার সঙ্গে খানিকটা খেলা করি, একবার তার মুখ থেকে কেড়ে নিই একবার গড়িয়ে দিই। আগে আগে যখন আমার উঠতে দেরি হত, সে তার বরাদ্দ বিস্কুট নিয়ে আমার শোবার ঘরের কাছে বসে ঘেউ ঘেউ করত। কিন্তু গোল করলে বিরক্ত হতুম দেখে সে এখন আর ঘেউ ঘেউ করে না। আস্তে আস্তে পা দিয়ে দরজা ঠেলে, যতক্ষণ না দরজা খুলে দিই চুপ করে বাইরে বসে থাকে। দরজা খুলে ঘর থেকে বেরোলেই লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে লেজ নেড়ে উৎসাহ প্রকাশ করে; তার পরে একবার বিস্কুটের দিকে চায় একবার আমার মুখের দিকে। যা হোক সাড়ে ন-টার মধ্যে ব্রেকফাস্ট শেষ হয়। তার পরে হাতে দস্তানা পরা গৃহিণী দাসীদের নিয়ে তাঁর চৌতলা থেকে একতলা পর্যন্ত, জিনিসপত্র গুছিয়ে ঘরদ্বার পরিষ্কার ও গৃহকার্য তদারক করে ওঠা-নাবায় প্রবৃত্ত। একবার রান্নাঘরে যান, সেখানে শাকওআলা, রুটিওআলা, মাংসওআলার বিল দেখেন, দেনা চুকিয়ে দেন। মাঝে মাঝে উপরে এসে কর্তার সঙ্গে গৃহকার্যের পরামর্শ হয়। রান্নাঘরের উপকরণ পরিষ্কার আছে কি না ও যথাস্থানে তাদের রাখা হয়েছে কি না দেখেন, ভালো মাংস এনেছে কি না, ওজনে কম পড়েছে কি না তদন্ত করেন। রাঁধুনীর সঙ্গে মাঝে মাঝে যোগ দেন। এইরকম ব্রেকফাস্টের পর থেকে প্রায় বেলা একটা-দেড়টা পর্যন্ত তাঁকে নানাবিধ কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গে তাঁর বড়ো মেয়ে যোগ দেন। মেজো মেয়ে প্রত্যহ একটি ঝাড়ন নিয়ে ড্রয়িংরুম সাফ করেন। দাসীরা ঘর ঝাঁট দিয়ে যায়, আর জিনিসপত্রে যা কিছু ধুলো লাগে তা তিনি নিজের হাতে ঝেড়ে-ঝুড়ে সাফ করেন। তৃতীয় মেয়ে বালিশের আচ্ছাদন আসন মোজা কাপড় প্রভৃতি নানাবিধ সেলাইয়ে নিযুক্ত হন, চিঠিপত্র লেখেন, এক-এক দিন বাজনা ও গান অভ্যাস করেন। বাড়ির মধ্যে তিনিই গাইয়ে বাজিয়ে। আজকাল স্কুল বন্ধ, ছোটো ছেলেটি ও মেয়েটি ভারি খেলায় মগ্ন। দেড়টার সময় আমাদের লাঞ্চ খাওয়া সমাপন হলে আবার যিনি যাঁর কাজে নিযুক্ত হন। এই সময়ে ঝিটিরদের আসবার সময়। হয়তো মিসেস ক—তাঁর স্বামীর এক জোড়া ছেঁড়া মোজা দিয়ে চশমা পরে ড্রয়িংরূমে বসে সেলাই করছেন। ছোটো মেয়ে একটি পশমের জামা তাঁর ভাইপোর জন্যে তৈরি করে দিচ্ছেন। মোজো মেয়েটি একটু অবসর পেয়ে আগুনের কাছে বসে হয়তো গ্রীনের লিখিত ইংরেজ জাতির ইতিহাস পড়তে নিযুক্ত। বড়ো মিস ক—হয়তো তাঁর কোনো আলাপীর বাড়িতে ভিজিট করতে গিয়েছেন। তিনটের সময় হয়তো একজন ভিজিটর এলেন। দাসী ড্রয়িংরূমে এসে নাম উচ্চারণ করলে “মিস্টার ও মিসেস এ—” বলতে বলতে ঘরের মধ্যে তাঁরা দু-জনে উপস্থিত। মোজা জামা রেখে বই মুড়ে গৃহিণী ও তাঁর কন্যারা আগন্তুকদের অভ্যর্থনা করলেন। আবহাওয়া সম্বন্ধে পরস্পরের মতামতের ঐক্য নিয়ে আলাপ শুরু হল। মিসেস এ—বললেন, “মিস্টার এক্‌স—এর তেতাল্লিশ বৎসর বয়সে হাম হয়। হাম হয়েছিল বলে তিন চারদিন আপিসে যেতে পারেন নি। কাল আপিসে গিয়েছিলেন। তাঁর হামের প্রসঙ্গে আপিসের লোকেরা তাঁকে নির্দয়রপে ঠাট্টা করতে আরম্ভ করেছে।” অন্যেরা লোকটি সম্বন্ধে দরদ প্রকাশ করলে। এই কথা থেকে ক্রমে হামরোগের বিষয়ে যত কথা উঠতে পারে উঠল। মিস ক—খবর দিলেন মিস্টার জ—এর যে এক পিতৃব্য বোন মিস ই—অস্ট্রেলিয়ায় আছেন, তাঁর কাপ্তেন ব—এর সঙ্গে বিবাহ হয়ে গেছে। এই রকম খানিকক্ষণ কথোপকথন হলে পর তাঁরা চলে গেলেন। বিকেলে হয়তো আমরা সবাই মিলে একটু বেড়াতে গেলুম। বেড়িয়ে এসে সাড়ে ছ-টার সময় আমাদের ডিনার। ডিনার খেয়ে সাতটার সময় আমরা সবাই মিলে ড্রয়িংরূমে গিয়ে বসি। আগুন জ্বলছে। ঘরটি বেশ গরম হয়ে উঠেছে। আমরা আগুনের চারদিকে ঘিরে বসলুম। এক-এক দিন আমাদের গান-বাজনা হয়। আমি ইতিমধ্যে অনেক ইংরেজি গান শিখেছি। আমি গান করি। মিস ক—আমাকে অনেকগুলি গান শিখিয়েছেন। কিন্তু প্রায় সন্ধ্যেবেলায় আমাদের একটু আধটু পড়াশুনো হয়। আমরা পালা করে ছ-দিনে ছ-রকমের বই পড়ি। বই পড়তে পড়তে এক-এক দিন প্রায় সাড়ে এগারোটা বারোটা হয়ে যায়। ছেলেদের সঙ্গে আমার খুব ভাব হয়ে গেছে। তারা আমাকে আর্থার বুড়ো বলে। এথেল ছোটো মেয়েটির ইচ্ছে যে আমি কেবল একলা তারই আঙ্ক্‌ল্‌ আর্থার হই। তার ভাই টম যদি আমাকে দাবি করে তবেই তার দুঃখ। একদিন টম তার ছোটো বোনকে রাগাবার জন্যে একটু বিশেষ জোর দিয়ে বলেছিল, আমারই আঙ্ক্‌ল্‌ আর্থার। তখনই এথেল আমার গলা জড়িয়ে ধরে ঠোঁট দুটি ফুলিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করে দিলে। টম একটু অস্থির, কিন্তু ভারি ভালোমানুষ। খুব মোটাসোটা। মাথাটা খুব প্রকাণ্ড। মুখটা খুব ভারি ভারি। সে এক-এক সময়ে আমাকে এক-একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করে। একদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করছিল, “আচ্ছা, আঙ্ক্‌ল্‌ আর্থার, ইঁদুররা কী করে?” আঙ্ক্‌ল্‌ বললেন, “তারা রান্নাঘর থেকে চুরি করে খায়।” সে একটু ভেবে বললে, “চুরি করে? আচ্ছা, চুরি করে কেন?” আঙ্ক্‌ল্‌ বললেন, “তাদের খিদে পায় বলে।” শুনে টমের বড়ো ভালো লাগল না। সে বারবার শুনে আসছে যে, জিজ্ঞাসা না করে পরের জিনিস নেওয়া অন্যায়। আর-একটি কথা না বলে সে চলে গেল। যদি তার বোন কখনো কাঁদে, সে তাড়াতাড়ি এসে সান্ত্বনার স্বরে বলে, “Oh poor Ethel, don’t you cry! Poor Ethel! “ এথেলের মনে মনে জ্ঞান আছে যে, সে একজন লেডি। সে কেমন গম্ভীরভাবে কেদারায় ঠেস দিয়ে বসে। টমকে এক-এক সময়ে ভর্ৎসনা করে বলে, “আমাকে বিরক্ত করো না।” একদিন টম পড়ে গিয়ে কাঁদছিল। আমি তাকে বললেন, “ছি, কাঁদতে আছে!” অমনি এথেল আমার কাছে ছুটে এসে জাঁক করে বললে, “আঙ্ক্‌ল্‌ আর্থার, আমি একবার ছেলেবেলায় রান্নাঘরে পড়ে গিয়েছিলেম, কিন্তু কাঁদি নি।” ছেলেবেলায়! মিস্টার ন—, ডাক্তারের আর এক ছেলে, বাড়িতে থাকেন কিন্তু তাঁকে দেখতে পাই নে। তিনি সমস্ত দিন আপিসে। আপিস থেকে এলেও তাঁর বড়ো একটা দেখা পাওয়া যায় না। তার কারণ মিস্‌ ই—র সঙ্গে তাঁর বিয়ের সম্বন্ধ। তাঁদের দু-জনে কোর্টশিপ চলছে। রবিবার দু-বেলা প্রেয়সীকে নিয়ে তাঁর চার্চে যেতে হয়। যখন বিকেলে একটু অবসর পান, প্রণয়িনীর বাড়িতে গিয়ে এক পেয়ালা চা খেয়ে আসেন। প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যেবেলা তাঁদের বাড়িতে তাঁর নেমন্তন্ন। এই রকমে তাঁর সময় ভারি অল্প। উভয়ে পরস্পরকে নিয়ে এমন সুখী আছেন যে, অবসরকাল কাটাবার জন্যে অন্য কোনো জীবের সঙ্গ তাঁদের আবশ্যক করে না। শুক্রবার সন্ধ্যেবেলায় যদি আকাশ ভেঙে পড়ে তবু মিস্টার ন—পরিষ্কার করে চুলটি ফিরিয়ে, পমেটম মেখে, কোট ব্রাস করে ফিটফাট হয়ে ছাতা হাতে বাড়ি থেকে বেরোবেনই। একবার খুব শীত পড়েছিল, আর তাঁর ভারি কাশি হয়েছিল; মনে করলেম, আজ বুঝি বেচারির আর যাওয়া হয় না। সাতটা বাজতে না বাজতেই দেখি তিনি ফিটফাট হয়ে নেবে এসেছেন।

যা হোক, আমার এই পরিবারের সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। সেদিন মেজো মেয়ে আমাকে বলছিলেন যে, প্রথম যখন তাঁরা শুনলেন যে, একজন ভারতবর্ষীয় ভদ্রলোক তাঁদের মধ্যে বাস করতে আসছে, তাঁদের ভারি ভয় হয়েছিল। যেদিন আমার আসবার কথা সেই দিন মেজো ও ছোটো মেয়ে, তাঁদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে পালিয়ে গিয়েছিলেন। প্রায় এক হপ্তা বাড়িতে আসেন নি। তার পর হয়তো যখন তাঁরা শুনলেন যে, মুখে ও সর্বাঙ্গে উল্কি নেই, ঠোঁট বিঁধিয়ে অলংকার পরে নি, তখন তাঁরা বাড়িতে ফিরে এলেন। ওঁরা বলেন যে প্রথম প্রথম এসে যদিও আমার সঙ্গে কথাবার্তা কয়েছিলেন তবুও দু-দিন পর্যন্ত আমার মুখ দেখেন নি। হয়তো ভয় হয়েছিল যে কী অপূর্ব ছাঁচে ঢালাই মুখই না জানি দেখবেন। তার পর যখন মুখ দেখলেন—তখন?

যা হোক, এই পরিবারে সুখে আছি। সন্ধ্যেবেলা আমোদে কেটে যায়—গান-বাজনা, বই পড়া। আর এথেল তার আঙ্ক্‌ল্‌ আর্থারকে মুহূর্ত ছেড়ে থাকতে চায় না।

===সমাপ্ত===

ইচ্ছাপূরণ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

সুবলচন্দ্রের ছেলেটির নাম সুশীলচন্দ্র। কিন্তু সকল সময়ে নামের মতো মানুষটি হয় না। সেইজন্যই সুবলচন্দ্র কিছু দুর্বল ছিলেন এবং সুশীলচন্দ্র বড়ো শা...